জীবনী
শওকত ওসমান। হয়ত নাম থেকে শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তিনি কেবল একজন সাহিত্যিক ছিলেন না, বনে গিয়েছিলেন গোটা বাংলার প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। তার সাহিত্যচর্চার নিবেশ দেখলেই টের পাওয়া যায় নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি। তবে তিনি শুধুমাত্র লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; এমনকি ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সাহায্য করায় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্ল্যাকলিস্টেও নাম পড়েছিল শওকত ওসমান এবং তার পরিবারের।
জন্ম ও শৈশব
১৯১৭ সালের ২রা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহাকুমার খানাকুল থানার অন্তর্গত সবলসিংহপুরে শেখ মোহাম্মদ এহিয়া এবং গুলজান বেগমের সংসার আলো করে জন্ম হয়েছিলো শওকত ওসমানের। শওকত ওসমানের পারিবারিক নাম ছিলো শেখ আজিজুর রহমান। শেখ পদবী পেয়েছিলেন পূর্বপুরুষ শেখ মেহেদীর নাম থেকে। শৈশব থেকেই তিনি কবিতা এবং গল্প লেখা শুরু করেন। এভাবে শৈশবেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তৈরি হয়।
নাম পরিবর্তনের রহস্য
সাহিত্যিচর্চায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে নাম পরিবর্তন করতে হয়। কেননা তৎকালীন সময়ে আজিজুর রহমান নামে একজন সর্বজন পরিচিত কবি ছিলেন। নিজেকে সমাজের সামনে আলাদাভাবে তুলে ধরতে তিনি ছদ্মনাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে নাম শওকত ওসমান-ই কেন রেখেছিলেন এর উত্তর পাওয়া যায় ভাই-বোনের ভালোবাসার সম্পর্কে। বোন সুফিয়া খাতুন ভাইয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলেন শওকত আলী। ১৯৩১ সালে সুফিয়া খাতুনের মৃত্যুর পর শওকত নামটি বোনের স্মৃতিরক্ষার্থে নিজের ছদ্মনামে ব্যবহার করেন। আর ওসমান পদবী নিয়েছিলেন মেজচাচার অকাল্প্রয়াণের স্মৃতিতে। নিজের পরিবার এবং সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধার ভার যেন তিনি সারাজীবন বহন করতে চান এবং করেছেন ও তাই। ১৯৩৮ সালে তিনি সাহিত্যিক শওকত ওসমান নামে আত্মপ্রকাশ করেন।
পরিবার
আমার পিতা ছিলেন সব কাজের কাজি
পিতা সম্পর্কে শওকত ওসমান বলেন, “একাধারে রাজমিস্ত্রী, পালিশ মিস্ত্রি, এমনকি জাগতিক কাজের বাইরে মসজিদের ইমামের অভাবে সেই কাজ চালিয়ে নেয়া, ইহকালের কাজ তিনি ভালো জানতেন। নানা কাজের কাজি অথচ প্রায়শই পিতার সন্ন্যাসীসুলভ নির্বিকারত্ব আমাদের বিপদে ফেলত।” শেখ মুহাম্মদ এহিয়া ছিলেন এক কথায় “সব কাজের কাজি”। পুত্র শওকত ওসমান পিতাকে হরফুন মওলা অর্থাৎ সর্ববিদ্যাবিশারদ আখ্যা দিয়েছিলেন। মূলত কৃষিজীবী পরিবারের অধিবাসী হলেও মিস্ত্রীগিরি, দোকানদারি; এমনকি শহরে গিয়ে কাঠগোলার ব্যবসাও করেছেন তিনি। ১৯৪৮ সালে শওকত ওসমানের পিতা মুহাম্মদ এহিয়া পরলোক গমন করেন।
স্নেহে ভরা মায়ের তীব্র শাসন
মুহাম্মদ এহিয়ার সারাদিন বাইরের কাজ এবং খামকেয়ালিপনার ফলে সংসারের হাল ধরেছিলেন শওকত ওসমানের মা গুলেজান বেগম। সন্তানদের ভবিষ্যত এবং পড়ালেখা নিয়ে গুলেজান ছিলেন কঠোরপ্রাণা। কিন্তু মমতা দিয়ে আগলে রাখতেও কমতি করতেন না কখনো। নিজে নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা-দীক্ষার মূল্য তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলেজে ভর্তি হতে বড় অংকের টাকার প্রয়োজন ছিলো যা তাঁর মা গোপনে নিজের গহনা বিক্রি করে যোগান দেন। মনের জোরে এরকম হাজারো প্রতিকূলতার বর্ণনা দিতে দিতে শওকত ওসমান বলেন, “ধরিত্রীর মতোন সর্বসংহা ছিলেন আমার মা। তাঁর শান্ত মুখের আদলে বিষাদের কোনো চিহ্ন থাকতো না বোবা দৃষ্টি স্নেহনির্ঝর।” ১৯৭২ সালে মাতা গুলেজান বেগমকে হারান শওকত ওসমান।
মায়ের থেকে দাদীর কাছে পালানো
শওকত ওসমানের দাদী খুশমন খাতুন ছিলেন শিশুকালের আশ্রয়স্থল। তাঁর মতে লেখাপড়া না শিখলেও হবে, তবে ছেলের গায়ে হাত দেয়া যাবেনা। এরই ফায়দা নিতেন শওকত ওসমান। পড়াশোনায় একটু এদিক ওদিক হলেই দৌড় দিতেন দাদী খুশীমনের কাছে। এদিকে মা লেখাপড়ায় ছাড় দিতেন না, আর দাদী-ই ছিলেন তাঁর সবথেকে নিরাপদ কোল। এমনকি দাদীর মৃত্যুর পরও স্কুলের পড়া এবং মায়ের পিটুনীর ভয়ে দাদীর ভাঙ্গা কবরে গিয়ে শুয়ে থাকতেন শওকত ওসমান। দাদীর ভালোবাসায় আসক্ত শওকত দাদীর স্মৃতিতে “রাহনামা - ১” রচনা করেন। দাদীর সরলতার কথা তিনি এভাবে বর্ণনা করেন “আমার দাদী ছিলের ম্যাক্সিম গোর্কির দাদীর মতো। অতি সরল, অতি নিরীহ, দশ পর্যন্ত গুণতে পারতেন না। অথচ অপরের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার ধর্ম রপ্ত করেছিলেন……সনাতন মানবতার সেই কোমল প্রস্তর শিলার ছায়ায় আমি দশ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ।”
শিক্ষাজীবন
শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের মক্তবে। শওকত ওসমানের জীবনের প্রথম শিক্ষক ছিলেন মৌলবী আইনুদ্দিন। তবে আইনুদ্দিন বেশিদিন পড়াতে পারেননি। তিনি চলে যাওয়ার পর শওকত ওসমান প্রাইভেট পড়া শুরু করেন শিক্ষক মোহাম্মদ আলীর কাছে। তবে ছোট্ট শওকত তখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনে পা রাখেনি। তবে মা গুলেজান ঠিকই টের পেয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়িই ছেলেকে স্কুলে দিতে হবে। মায়ের আগ্রহে শিশু শওকত গ্রাম থেকে আড়াই মাইল দূরে নন্দনপুরে রূপচাঁদভুক্ত একাডেমিতে শিশুশ্রেণী ক্লাস ‘সেভেনস’- এ ভর্তি হয়েছিলেন। শিক্ষাজীবন সম্পর্কে তিনি বলেন - “বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন জন আমার ইমাম, মক্তবে ছিলেন মৌলবী আইনুদ্দিন। তিনি খুলনা জেলার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর কাছেই আমার হাতেখড়ি। তাঁর স্নেহ আমাকে লেখাপড়ার দিকে আকৃষ্ট করেছিলো। বছর তিনেক পর হঠাৎ তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতি আমাকে বহুদিন আবিষ্ট রেখেছিলো।”
শিক্ষক চলে যাওয়ায় বন্ধ হলো মক্তব
“মক্তবে যেতাম কিন্তু তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। কারণ শিক্ষকের অনুপস্থিতি। মা পাশের গ্রামের নন্দনপুর হাইস্কুলের কথা শুনেছিলেন। কাজী বাড়ির ছেলেমেয়েদের বাড়িতে পড়াশোনার জন্য তখন একজন পন্ডিত এসসেছিলেন। নাম আব্দুল আজিজ খান, তিনি ছিলেন ওই হাইস্কুলের সেকেন্ড পন্ডিত, কাজীদের ছেলেদের সকালে পড়িয়ে স্কুলে যেতেন। আড়াই মাইল পথ নন্দনপুরে। স্কুলটির পত্তন করেছিলেন রূপচাঁদভুক্ত এক বদান্যতাসিক্ত আত্মা। তখন এই এলাকায় কোনো হাইস্কুল ছিলো না। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের এই অভাব তিনি দূর করেছিলেন।” কথাগুলো শওকত ওসমানের। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বিপত্তি দেখা দেয় যখন মক্তবের মৌলবী আঈনুদ্দিন মক্তব ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি আড়াই মাইল দূরে নন্দনপুরের হাইস্কুলে ভর্তি হন। তবে গ্রামে নতুন মাদ্রাসা হলে তিনি আবার হাইস্কুল ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন।
শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র শওকত
১৯২৬ -এ সবলসিংহপুরে জুনিয়র মাদ্রাসা স্থাপিত হলে শওকত ওসমান নন্দনপুরে একাডেমি থেকে আবার নিজ গ্রামের মাদ্রাসায় চলে আসেন যেখানে তিনি মোট তিন বছর অধ্যয়ন করেন। মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল হালিমের প্রিয় ছাত্র ছিলেন শওকত। তিনি ভেবেছিলেন শওকত গোটা বঙ্গে প্রথম হবেন। তবে সেবার একটু হতাশ হতে হয়েছিল শিক্ষককে। কারণ শওকত প্রথম দশজনের ভিতরেও আসতে পারেননি। যদিও পরবর্তীতে শিক্ষকের সাহায্যে তিনি কলকাতায় লেখাপড়ার সাহায্য এবং সুযোগ পান।
কলকাতায় এসে শিক্ষাজীবনের পালাবদল
মাধ্যমিক শেষে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে শওকত ওসমান কলেজ শুরু করেন কলকাতায়। এসময়েই মা গুলেজান গোপনে নিজের গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলেন ছেলের পড়াশোনার জন্য। কলকাতার ধর্মতলা স্ট্রীটে থেকে পড়াশোনা করতেন। অল্প করেকদিন পর, ১৯৩০ এর জানুয়ারিতে ভর্তি হন মাদ্রাসা-এ-আলিয়ায়। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাদ্রাসায় অধ্যয়নের পর তিনি মাদ্রাসার ওল্ড স্কীম ছেড়ে চলে আসেন অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে।
সাহিত্যে আগমন
শওকত ওসমান ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে সখ্যতা গড়েছিলেন। ১৯৩২ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম গল্প লিখেন যা আলিয়া মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগের ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। তাঁর প্রথম কবিতাও লোকসম্মুখে আসে একই ম্যাগাজিনে। তাঁর কাব্যচর্চা সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেনঃ “শওকত ওসমান এক সময় কবিতা লিখত। বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং ঋতুচক্রের আবর্তের মধ্যে মানুষকে স্থাপিত করে কয়েকটি মনোরম কবিতা সে লিখেছিল। এরপর কবিতার ধারাক্রমের মধ্যে যদিও সে আর রইল না, কিন্তু কবিতার একজন সচেতন পাঠক হিসেবে সব সময় আমি তাকে পেয়েছি।”
ইংরেজী বিভাগ থেকে ম্যাট্রিক পাস
তিনি মাদ্রাসা-এ-আলিয়ায় ইংরেজী বিভাগের ছাত্র হিসেবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তাঁর দ্বিতীয় ভাষা ছিল আরবী। ইংরেজীর পাশাপাশি আরবীতেও খুব ভালো নম্বর পেয়ে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ।
কলেজের পুরো খরচ চালিয়েছেন মাইলদূর টিউশনি করে
১৯৩৪ সালে আই. এ. ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। পড়াশোনার খরচ চালাতে সকাল-সন্ধ্যা টিউশনি করতেন। কিছু টাকা বাড়িতেও পাঠাতেন। তাঁর নিজের ভাষায়ঃ “ধর্মতলা স্ট্রীট থেকে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে মল্লিক বাজার। তারপর ডাউনে পার্ক স্ট্রীট ধরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। তিন মাইলের মতো রাস্তা অনুমানে । সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়তাম সকালের টিউশনি ধরতে। “ সহজে লুটিয়ে পড়ার পাত্র ছিলেন না শওকত ওসমান। বিকেলে কলেজ শেষে আবার সন্ধ্যায় টিউশনি। এভাবে চলতে চলতে ১৯৩৬ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। সাহিত্যে তাঁর পদাচরণের আভাস সেসময় থেকেই পাওয়া যাচ্ছিলো। কলেজে থাকাকালীন একবার সাহিত্য সমিতি কর্তৃক আয়োজিত বার্ষিক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বি.এ. ক্লাসের ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তখন প্রধান বিচারক অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন যা ভবিষ্যতে তাঁকে আরো প্রেরণা জোগায়।
কলেজে হাবিবুল্লাহ বাহারের সাথে সাক্ষাৎ
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে পরিচয় হয় শওকত ওসমানের অন্যতম একজন আদর্শ বিখ্যাত 'বুলবুল' পত্রিকার সম্পাদক হবীবুল্লাহ বাহার-এর সঙ্গে। এটি শওকত ওসমানের লেখক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর জবানীতেঃ “আমার সাহিত্য জীবনের বিশেষ অধ্যায় হবীবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ কেন বরং বলা যায় জীবনের বিকাশের জন্যে যে আবহাওয়াটুকু প্রয়োজন, যা ছাড়া হয়ত তার বিনাশই ঘটে বা বিকাশ বাধা পায় এমন সংকটসংকুল মুহূর্তের দিশারী অধ্যায়।”
প্রথম চাকরি, সাথে পড়াশোনা
কলেজ টিউশনি করে শেষ করলেও অর্থকষ্ট তখনো পিছু ছাড়েনি। কলকাতা কর্পোরেশনে দেড় মাস কেরানির চাকরি নেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েটের পর সেন্ট জেভিয়ার্সেই তিনি অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন । কিন্তু অনার্স ছাড়াই ১৯৩৮ সালে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ছাত্রজীবনেই করেন বিবাহ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নকালে হাওড়া জেলার ঝামটিয়া গ্রামের অধিবাসী শেখ কওসর আলী ও গোলাপজান বেগমের কনিষ্ঠ কন্যা সালেহা খাতুনের সাথে ১৯৩৮ সালের ৬ মে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়।