কথাশিল্পী শওকত ওসমানের জীবনের ঘটনাপঞ্জি
১৯২২
শিক্ষাজীবনের শুরু
নিজ গ্রাম সবলসিংহপুরের একটি মক্তবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শুরু করেন শিক্ষাজীবন। প্রথম শিক্ষক ছিলেন মৌলবী আইনুদ্দিন। শিক্ষক চলে গেলে মক্তব বন্ধ হয়ে যায় এবং শওকত ওসমান মোহাম্মদ আলীর কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হন গ্রাম থেকে আড়াই মাইল দূরে নন্দনপুর রূপচাদভুক্ত একাডেমীর ক্লাস সেভেনে।
১৯২৬-২৯
ফিরে আসেন নিজ গ্রামে
নন্দনপুরের একাডেমিতে তিন বছর অধ্যয়নের পর গ্রামের মাদ্রাসায় চলে আসেন। এখানে সান্নিধ্য গ্রহণ করেন শিক্ষক আবদুল হালিমের। আবদুল হালিম শওকত ওসমানকে নিয়ে আশাতীত ছিলেন। ভেবেছিলেন প্রিয় ছাত্র পুরো বঙ্গের শ্রেষ্ঠ হবেন। তবে তাকে নিরাশ হতে হয় যখন জানতে পারেন শওকত প্রথম দশজনের মধ্যেও ফলাফল আনতে পারেন নি।
১৯২৯-৩০
মায়ের গহনা বিক্রি
কলকাতায় পড়তে যাওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজনে মাতা গুলেজান বেগম গোপনে নিজের গহনা বিক্রি করে দেন। ১৯৩০ এর ডিসেম্বরে ধর্মতলা স্ট্রীটে থেকে কলকাতায় মাদ্রাসা-এ-আলিয়ায় সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর মাদ্রাসার ওল্ড স্কীম ছেড়ে চলে আসেন অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে।
১৯৩২
মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম গল্প প্রকাশিত
লেখালেখির ভূত ছোট থেকেই পেয়ে বসেছিলো ছোট্ট শওকতকে। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথম গল্প প্রকাশ করেন মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগের ম্যাগাজিনে। প্রথম কবিতাও তিনি একই ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৩৩
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
মাদ্রাসা-এ-আলিয়া থেকে ইংরেজী বিভাগ থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার দ্বিতীয় ভাষা ছিলো আরবী। ইংরবজী এবং আরবীতে সমান দক্ষতা দিয়ে ভালো ফলাফল করেন শওকত ওসমান।
১৯৩৮
ছাত্রজীবনেই চাকরির শুরু
নিজের কলেজের খরচ চালিয়েছেন টিউশনি করে। তবে অর্থকষ্টে একসময় কলকাতা কর্পোরেশনে কেরানীর চাকরী নেন। এখানে দেড় মাস চাকরীর করেন এবং একইসাথে ইন্টারমিডিয়েটে সেন্ট জেভিয়ার্সে অর্থনীতিতে ভর্তি হন।
১৯৩৮
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন
কলকাতা বিশববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯৩৮ এর ৬মে বিবাহ সম্পন্ন করেন কওসর আলী এবং গোলাপজান বেগমের কনিষ্ঠ কন্যা সালেহা খাতুনের সাথে।
১৯৪১
৩১ মার্চ
মহাকবি ইকবালের মৃত্যু দিবসের দুঃসাহসিক ঘটনা
কলকাতার মুসলিন ইন্সটিটিউটে একজন বক্তা উর্দুতে বক্তব্য দেয়ায় প্রতিবাদ করে বসেন শওকত ওসমান। তিনি জনগণের ক্ষমতা সম্পর্কে আবার মনে করিয়ে দেন মুসলিম লীগ নেতাদের। যদিও অনুষ্ঠানের পর নেতার লোকদের কাছে ঘুষি খেয়ে তাকে তিনদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল।
১৯৪১
প্রভাষক শওকত ওসমান
কলকাতার ইন্সটিটিউট অব কমার্সে বাংলাসাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে দায়িতব নেন ১৯৪২ এ। ৪৭ এর দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। এখানেই তিনি বিধ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন।
১৯৪১
ধর্মতলার ৪৬ নং বাড়ি
কলকাতার ধর্মতলা ৪৬ নং স্ট্রীটে ফ্যাসিবিরোধী লেখক এবং শিল্পীসংঘের অফিস হয়েছিলো। রাজনীতিবিদ হোক কিংবা লেখক, সকলের আনাগোনা ছিলো এই বাড়িতে। শওকত ওসমানও ছিলেন এখানে নিয়মিত একজন।
১৯৪৩
মন্বন্তরে করেছিলেন অনুবাদকের চাকরি
শওকত ওসমানের জীবিকা নিয়ে এত বাছ-বিচার ছিলো না। তার উপর '৪৩ এ আসে দুর্ভিক্ষ। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি চিন্তার ভাজ ফেলে। সেসময় সরকার কিছু সংখ্যক অনুবাদক এবং সরকারী পরিচালক নিয়োগ দেন যেখানে শওকত ওসমান নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বেতন-ভাতা মিলে ১১০-১১৫ টাকা পেতেন। তবে অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা অনুবাদ করার সুযোগ হয়েছিলো এখানে।
১৯৪৪
প্রথম গ্রন্থ "ওটেন সাহেবের বাংলো"
২৭ বছর বয়সে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেন। "ওটেন সাহেবের বাংলো" শিরোনামে একটি শিশুতোষ রচনা প্রকাশ করেন শওকত ওসমান। সর্বমোট ৬টি গল্প নিয়ে বইটি সাজানো। গল্পগুলি হলঃ “ওটেন সাহেবের বাংলো, দু’টি নোট, দুই বন্ধু, গরিলা, সুন্দরবনের বাঘ, ও পুপুর সফর”।
১৯৪৪-৪৫
বিখ্যাত উপন্যাস জননীর প্রথম সংস্করণ
সেসময়কার বিখ্যাত পত্রিকা এবং প্রকাশক "সওগাত"-এ জননী আংশিক প্রকাশ পায়। ব্রিটিশ আমলে গ্রামকাহিনী নিয়ে রচিত উপন্যাসটি সেসময় "জিন্দান" নামে প্রকাশ পেয়েছিলো।
১৯৪৬
প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস "বনী আদম" প্রকাশ
১৯৪৬ এ ঈদের সময় কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বনী আদম। এটিই ছিলো তার প্রথম পূর্ণাংগ উপন্যাস রচনা। গ্রাম এবং শহরের পটভূমিতে দুঃখ দারিদ্রতার জীবনদর্শনের গল্পই হচ্ছে বনী আদম। কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় শওকত ওসমানের প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস "বনী আদম" প্রকাশিত হয়। গ্রাম ও শহরের পটভূমিতে নানান মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য তৎসঙ্গে কিছু ভঙের জীবনদর্শণ হচ্ছে শওকত ওসমানের 'বনী আদম'। উপন্যাসে '৪৩ এর দুর্ভিক্ষকে সামনে থেকে উপস্থাপন করেছেন লেখক শওকত ওসমান ।
১৯৪৭
দেশ বিভাগের সময় চলে আসেন চট্টগ্রামে
১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান বিভাগের সময় চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। সাহিত্যবন্ধুদের টানে শওকত ওসমান পূর্বপাকিস্তানে এসে যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে। রাষ্ট্রবিভাগ নিয়ে সেরকম উৎকন্ঠা না থাকলেও স্বজনদের কাছাকাছি থাকতেই পূর্ব পাকিস্তানে আসেন তিনি।
১৯৪৭
আবুল ফজলের সান্নিধ্য গ্রহণ
চট্টগ্রামে আসার পর তিনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজলের সান্নিধ্য লাভ করেন। আবুল ফজল বরাবরই শওকত ওসমানের প্রশংসা করতেন। তার আত্মজীবনীতেও শওকত ওসমানের কথা লিখেছেন বহুবার। তার উক্তিতে-"...আমাদের উত্তরসূত্রীদের মধ্যে যে কয়জন সাহিত্যকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন আর তাতে আত্মনিবিষ্ট তার মধ্যে শওকত ওসমান অন্যতম। এছাড়া "সীমান্ত" পত্রিকায় বিনা পারিশ্রমিকে বেশ কিছুদিন লিখেছেন তিনি।
১৯৫১ - ৫৫
সৃজনশীলতার প্রতীক শওকত
জীবিকা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুব কম অঙ্গন এড়িয়ে চলেছেন শওকত ওসমান। তার লেখার কারুকার্য দিয়ে তিনি একাধারে গল্প, উপন্যাস, নাটক সব ধরনের গ্রন্থ লিখে গেছেন। ১৯৫১-৫৫ এই ৫ বছরে তার ৭টি ভিন্নরকম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে ছিলো নাটক, উপন্যাস, গল্পের মিশ্রণ। এ সময়ে তিনি সৃজনশীলতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৬০-৬৯
সাহিত্য অঙ্গনে সর্বাধিক সফল সময়
সাহিত্যচর্চায় কোনো কমতি ছিলো না কোনোকালেই। তবে ‘৬০ এর দশক ছিলো তার সর্বাধিক সফল সময়। শওকত ওসমানের সর্বাধিক জনপ্রিয় দুটি উপন্যাস 'জননী' এবং 'ক্রীতদাসের হাসি’ এই দশকে প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পুরস্কার তিনি এই সময়েই অর্জন করেন। তিনি এসময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্রভাষক হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। সাহিত্যিক হিসেবে লোকমুখে জনপ্রিয়তা পেলে এর প্রভাব শিক্ষকতা জীবনে ছাত্রদের ভিতরেও কম ছিলোনা। পরবর্তীকালে সফল ছাত্ররা রেখেছেন সীমাহীন প্রশংসা।
১৯৬১
জননীর পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশ
১৯৪৪-৪৫ এর সময়ে "জননী" উপন্যাসটি পত্র পত্রিকায় আংশিকভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তবে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ পায় ১৯৬১ তে। সন্তানের প্রতি মায়ের অগাধ ভালোবাসা ও মমত্ববোধ প্রকাশ হয় "জননী" উপন্যাসে। শওকত ওসমানের সার্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাসমূহের একটি জননী।
১৯৬১
বিখ্যাত উপন্যাস "ক্রীতদাসের হাসি" প্রকাশিত।
ক্রীতদাসের হাসি মূলত একটি শহর এবং গ্রামের পটভূমিতে দারিদ্রতা এবং আত্মার মান রক্ষার কাহিনী। স্বার্থ, প্রেম, ক্ষোভ, রাগ মিশ্রিত সার্থক একটি লেখ্যরূপ। ঘটনাক্রমে এর পুরোনো সহপাঠীর দাদার থেকে তিনি এরাবিয়ান নাইটস এর শেষ পান্ডুলিপিখুঁজে পান। আর এখান থেকেই "ক্রীতদাসের হাসি"-র সৃষ্টি। ১৯৬১ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
১৯৬১
বাংলা একাডেমি এবং আদমজী পুরস্কার অর্জন
শওকত ওসমান তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ছোটগল্পের জন্য 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার' পান । একই বছরে তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস 'ক্রীতদাসের হাসি'-র জন্যে পান বিখ্যাত 'আদমজী পুরস্কার'।
১৯৬৪
প্রথমবার প্যারিস গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের সাথে আড্ডা
ঢাকা কলেজের প্রভাষক হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ খবর পেয়ে তাকে প্যারিসে বড়দিনের আমন্ত্রণ দেন যা তিনি সাদরে গ্রহণ করেন; এমনকি ক্রিসমাসের বহু আগেই গিয়ে উপস্থিত হন। ১৯৬৫ এর ইংরেজি নববর্ষ তিনি সেখানেই কাটিয়েছিলেন। তাদের সাহিত্য আড্ডা, সীন নদীর তীরে হেটে বেড়ানো শওকত ওসমানকে ভাবিয়েছিলো বহুদিন। এরপর শওকত ওসমান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেও সফর করেছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মানবজাতির ভবিষ্যতের সম্পর্ক অনুধাবন করেন।
১৯৬৫
দ্বিতীয়বার প্যারিস ভ্রমণের সময় বিপত্তি
'প্রস্তরফলক' নামক গল্পগ্রন্থ প্রকাশ । 'স্পেনের ছোটগল্প' এবং 'মলিয়র-এর পাঁচটি নাটক' অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ । শওকত ওসমান বন্ধু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আমন্ত্রণে ১৫ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো প্যারিস যান। সেদিন অবরোধ-ধর্মঘট থাকায় শওকত ওসমানকে অন্য পার্শ্বস্থ বিমান বন্দরে নামতে হয় এবং নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধিতে বিভিন্ন কৌশলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বাড়ি পৌঁছতে হয়েছিল ।
১৯৬৭
পাকিস্তানের ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ অর্জন
শওকত ওসমান সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিসেবক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মাননা 'পাকিস্তান গভর্নমেন্ট পুরস্কার লাভ' (প্রাইড অব পারর্ফমেন্স) অর্জন করেন।
১৯৬৭
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উপন্যাস 'সমাগম'-এর প্রকাশ
'সমাগম' নামক ব্যতিক্রমী চিন্তার উপন্যাস প্রকাশ করেন এই সময়ে। বক্তব্য প্রধান এই উপন্যাসে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব যুদ্ধের বিপক্ষে ও শান্তিকল্যাণের পক্ষে লেখক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। বর্তমান সমাজের অবক্ষয়-অস্থিরতা অতীতের প্রয়াত মনীষীদের ভাবনা এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীর কল্যাণ সাধনে বর্তমানের ভূমিকা কি হওয়া উচিত সেই সূত্র ধরে 'সমাগম' উপন্যাসের জন্ম।
১৯৭০
ইরান ও তুরস্কের সাহিত্যের প্রভাব
শওকত ওসমান ইরান ও তুরস্ক সফর করবার সুযোগ পান। এ সময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন অনুবাদক কবীর চৌধুরী। সফররত দেশ দু'টিতে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত বক্তৃতা প্রদান করেন। তুরস্ক সফরকালে সে দেশের ভাষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যে জাতীয়তাবাদের সমর্থন ও প্রভাব প্রত্যক্ষ করে শওকত ওসমান বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত হন এবং প্রণোদনা অনুভব করেন যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখিত ও প্রমাণিত।
১৯৭০
মুক্তিকামীদের গ্রন্থ “রাজা উপাখ্যান” প্রকাশ
'রাজা উপাখ্যান' নামক রূপকাশ্রয়ী উপন্যাস প্রকাশিত। ষাটের দশকের সামরিক শাসনের শৃঙ্খলমোচনের জন্য মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রাম-সংকল্প ও প্রত্যয়-প্রত্যাশা এ উপন্যাসে শিল্পিত ভাষ্যে রূপায়িত । কাহিনীর সূচনা অংশে লেখক মহাকবি ফেরদৌসীর পুরস্কার বঞ্চিত বিষাদময় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে উপাখ্যানের কাহিনীর অবতারণ করেছেন। শাহনামা রচনার জন্যে সুলতান মাহমুদ প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কবিকে পুরস্কৃত করেননি। দুঃখভারাক্রান্ত কবি গজনি ছেড়ে যাবার প্রাক্কালে সুলতান মাহমুদের গ্রন্থাগারিকের কাছ থেকে বইটির পাণ্ডুলিপি নিয়ে সেখানে নতুন অধ্যায় যোগ করেন। কিন্তু প্রাণভীতিময় অবস্থায় তা শেষ করতে পারেননি । শওকত ওসমান তাঁর এই গ্রন্থে ফেরদৌসীর এই অসমাপ্ত কাহিনী সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া এসময় আনোয়ারা বাহার চৌধুরীর সহযোগিতায় 'হবীবুল্লাহ বাহার' নামক স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শন এবং দেশত্যাগ
২৫শে মার্চের নৃশংসতা বর্ণনা করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্ল্যাক লিস্টে নাম আসে শওকত ওসমানের। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার কারণে বাধ্য হয়ে বর্ডার পার হয়েছিলেন। তাঁর ভারতযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে 'জাহান্নম হইতে বিদায়' রচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই উপন্যাসে।
১৯৭৩
মুক্তিযুদ্ধের জয়গান তুলে ধরেছেন আজীবন
প্রতিবাদী কণ্ঠে সবসময় উজ্জ্বল ছিলেন যার নিদর্শন মুক্তিযুদ্ধের সময় বারবার দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শওকত ওসমানের 'দুই সৈনিক' এবং 'নেকড়ে অরণ্য' নামক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। একই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে কিশোর-যুবাদের দুঃসাহসিক অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে 'ক্ষুদে সোশ্যালিস্ট' নামক শিশুতোষ উপন্যাস রচনা করেন। উপন্যাসের পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে 'সমুদ্র নদীসমর্পিত' নামক প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।
১৯৭৪
শওকত ওসমানের 'শ্রেষ্ঠগল্প' প্রকাশ
প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্য থেকে সুনির্বাচিত অংশ নিয়ে শওকত ওসমানের 'শ্রেষ্ঠগল্প' প্রকাশ পায়। এছাড়া উপন্যাস 'জলাংগী' এবং প্রবন্ধগ্রন্থ 'ভাব ভাষা ভাবনা' প্রকাশিত ।
১৯৭৫
মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠে শওকত ওসমান
বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ 'জন্ম যদি তব বঙ্গে' এবং আত্মব্যাঙ্গাত্মক কাব্য 'নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত' গ্রন্থকারে প্রকাশিত। পাঞ্জাবি লেখক অমৃতা প্রীতমের উপন্যাস 'সন্তানের স্বীকারোক্তি' অনুবাদ প্রকাশ। শিশুতোষ উপন্যাস 'পঞ্চসঙ্গী' প্রকাশিত। পঁচাত্তরে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হবার পর প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকা ত্যাগ করে কলকাতা যান। সেখানে তিনি প্রায় ৬ বছর অবস্থান করেন ।
১৯৭৬
ক্রীতদাসের হাসি-র ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ
অল্প সংখ্যক ইংরেজী অনুদিত গ্রন্থ ও শওকত ওসমানের গ্রন্থাগারে ঠাই পেয়েছিলো। তবে তাঁর 'ক্রীতদাসের হাসি'র ইংরেজী অনুবাদ "Laughter of Slave" প্রকাশিত অনুবাদ করেন কবীর চৌধুরী।
১৯৮১
আবার দেশে ফিরে আসেন
৬ বছর কলকাতায় অবস্থানের পর বাংলাদেশে প্রত্যাগমণ করেন। ঢাকাকে তিনি মাথুরা নগর বলে ডাকতেন আর কলকাতাকে বজ্রধাম। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি অনুযায়ী ১৯৮১ সালের ২৪ এপ্রিলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৮৩
একুশে পদক অর্জন
বাংলা সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন ১৯৮৩ সালে।
১৯৮৫
স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা
১৯৮৫ তে বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেন শওকত ওসমান। পূর্বরচিত উপন্যাস 'আর্তনাদ' বাংলা একাডেমিতে প্রকাশ পায়। এছাড়া 'ইতিহাসে বিস্তারিত' নামক প্রবন্ধ গ্রন্থ এবং 'রাজা উপাখ্যান' ও 'ঈশ্বরর প্রতিদ্বন্দ্বী’-র ইংরেজি অনুবাদ 'The King and The Serpents' এবং 'God's Adveresary and Other Stories' প্রকাশ পায়।
১৯৮৬
এক বছরে দশটি গ্রন্থ প্রকাশ
বলা যায়, এই বছরটি ছিলো শওকতময়। প্রকাশনার দিক থেকে এই বছরে সর্বমোট দশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার নামে। কোনো নির্দিষ্ট ধরন নয় বরং হরেক ঘরানার লেখা ছিলো এই তালিকায়। সেই বছরে 'মনিব ও তাহার কুকুর', 'এবং তিন মির্জা','রাজসাক্ষী', 'পিতৃপুরুষের পাপ', 'জন্ম জন্মান্তর','নিঃসঙ্গ নির্মাণ', 'কালরাত্রি খন্ডচিত্র’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ প্রকাশ পায়।
১৯৮৯
ঢাকায় শিল্পী সাহিত্যিকদের সংবর্ধনা প্রাপ্তি
এ বছর 'তিনটি ছোট নাটক' নামক একটি নাট্যসংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে তাঁর ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা তথা দেশের শিল্পী সাহিত্যিকরা সংবর্ধনা প্রদান করেন। এ উপলক্ষে 'শুভ জন্মদিন' শিরোনামে একটি সুভ্যেনির প্রকাশিত হয়।
১৯৯০
‘রাষ্ট্রপতির কাছে খোলা চিঠি’
৮০-র দশকের সামরিক আইন ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিপর্যয় শওকত ওসমানকে বেদনাদগ্ধ করেছিল। তাঁর 'পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা' গ্রন্থে সামরিকতন্ত্রের প্রতি তিনি বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দেন। ১৯৯০ সালের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর তিনি সংবাদ পত্রিকায় 'রাষ্ট্রপতির কাছে খোলা চিঠি' শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন। এছাড়া একই বছরে বহুল আলোচিত গল্পগ্রন্থ 'ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী' এবং প্রবন্ধগ্রন্থ 'পূর্ণ স্বাধীনতা' প্রকাশ পায়।
১৯৯২
আরো সম্মাননা অর্জন
১৯৯২ সালে শওকত ওসমান 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার' সম্মননা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের লেখকবৃন্দকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭৩ সাল থেকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।
১৯৯৩
মুজিবনগরের বিশেষ স্মৃতিচারণা
শওকত ওসমান ‘উত্তরপর্ব মুজিবনগর' নামক সুবিশাল স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি এই গ্রন্থটি লিখেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানকালের স্মৃতিময় বিবরণ হলো এই সুপাঠ্য গ্রন্থটি।
১৯৯৩
ইংল্যান্ডে ‘জননী’-র ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ
১৯৯৩ সালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ইংল্যান্ড থেকে শওকত ওসমানের 'জননী' উপন্যাসের ইংরেজী সংস্করণ ‘Janani’-র প্রকাশ। লন্ডনের হাইনেম্যান পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত 'জননী' গ্রন্থের ইংরেজী শিরোনামও তিনি দিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে ‘The State Witness' নামে শওকত ওসমানের 'রাজসাক্ষী' উপন্যাসটির ইংরেজী অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।
১৯৯৫
সত্যেন সেন পুরস্কার অর্জন
'মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা' এবং 'অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ' নামে দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশ পায়। পাশাপাশি 'শেখের সম্বরা' নামে ব্যঙ্গকাব্যটির দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ডটিও প্রকাশিত হয়। এ সময় শওকত ওসমান সাহিত্যিক 'সত্যেন সেন পুরস্কার ১৯৯৫'-এ ভূষিত হন।
১৯৯৬
স্বাধীনতা পদক লাভ
বাংলাদেশের জাতীয় ও সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক। দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ঘোষিত 'স্বাধীনতা পদক' লাভ করেন শওকত ওসমান।
১৯৯৬
হৃদরোগে আক্রান্ত
প্রথমবারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে দু'মাস শয্যাশায়ী থাকেন।
১৯৯৮
জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি ২ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে শওকত ওসমানের ৮১তম জন্মদিনে প্রকাশিত স্মরণিকা 'বভার্যা'তে বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমান তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেনঃ এদেশের প্রতিটি বিবেকী মানুষ আপনার রচনাসমূহের পক্ষে, হে প্রেরণাসঞ্চারী অঙ্গ, এদেশের প্রতিটি সাহসী, অগ্রসর মানুষ আপনার সুদীর্ঘ জীবনের পক্ষে, আপনার এঁটোর মুকুটে করুক পুষ্প বিকাশের সুর, আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তের আনন্দধারা । সাহিত্যজীবনের সহচর আবুল হোসেনের শ্রদ্ধাঞ্জলি জন্মবার্ষিকীর স্মরণিকায় শওকত ওসমানের সুদীর্ঘকালের বন্ধু এবং সাহিত্যজীবনের সহচর আবুল হোসেন লিখেছেনঃ খুটখাট এক দুই আর নয় এখন তো চৌয়া ছক্কা মারার সময় মারো যত পারো দেখো, কত দূর যায়!
১৯৯৮
২৯ মার্চ
অসুস্থ হয়ে পড়েন
২৯ মার্চ সকালে হঠাৎ বাথরুমে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরিচর্যাকারী এবং পরিবারের সদস্যরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রথমে একটি ক্লিনিক, তারপর বারডেম হাসপাতাল এবং সর্বশেষ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, শওকত ওসমান সেরিব্রাল ইনফার্কসান জনিত ম্যাসিভ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। স্ট্রোকে তাঁর শরীরের একাংশ সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে যায়।
১৯৯৮
১৪ মে
মৃত্যু এবং শেষকৃত্য
১৯৯৮ সালের ১৪ই মে, শুক্রবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শওকত ওসমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। পরদিন শনিবার জানাযা শেষে দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে বাংলাদেশের এই বৈচিত্র্যসন্ধানী জীবনদৃষ্ট এবং আপসহীন লেখকব্যক্তিত্ব শওকত ওসমান মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত হন।